Apan Desh | আপন দেশ

ইসলামের আলোকে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ

আপন দেশ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:২৮, ২৪ জুন ২০২৪

আপডেট: ১৬:০৫, ২৪ জুন ২০২৪

ইসলামের আলোকে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ

ছবি : সংগৃহীত

করযে হাসানা অতি পূণ্যময় একটি আমল এবং মানবতার কল্যাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারী এশটি মাধ্যম। ঋণদাতা কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে অতিভাগ্যবান মানুষ। সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর কোনো জুলুম করে না। তার সাহায্য ত্যাগ করে না। যে তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে থাকেন। আর যে কোনো মুসলমানের একটি বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার কিয়ামতের দিনের বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দিবেন। [বুখারী, হাদীস: ২৪৪২; মুসলিম, হাদীস: ২৫৮০]।

অন্য এক হাদীসে মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন, কোনো একজন মুসলমান অন্য মুসলমানকে একবার ঋণ দিলে এ ঋণদান আল্লাহর রাস্তায় সে পরিমাণ সম্পদ দু’বার সদকা করার সমতুল্য হয়। [মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত, সূরা বাকারাহ, আয়াত: ২৪৫, পৃষ্টা: ১৩৫]। হাদীসগুলোর ম্যাসেজ হলো, করযে হাসানা খুবই পূণ্যময় একটি আমল। দেনাদার ঋণ আদায়ে অক্ষম হলে তা মাফ করে দেয়া আরো ভালো। কিন্তু খোদার এই আজব দুনিয়ায় এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়াত কম নয় যারা ঋণ নেয়ার পর তা আদায়ের কথা বেমালুম ভুলে যায়। 

অনেকেই আবার সামর্থ্য থাকা সত্বেও ঋণ পরিোধের সময় ঘোরাতে ঘোরাতে ঋণদাতার বারোটা বাঝিয়ে দেয়। কেউ কেউ তো পুরো টাকাটাই মেরে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে আহত-নিহত হওয়ার মত ঘটনাও ঘটে। ফলে মানুষের মনে হাসানার ব্যাপারে এক ধরণের নেতিবাচ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ সকল ফটকাবাজদের কারণে সমাজের ভালো মানুষগুলো বিপদের সময় করযে হাসানা পায় না। এজন্য ইসলামী শরীআতের পক্ষ থেকে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয় শ্রেণীর জন্য রয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। এ সকল নির্দেশনা মেনে চললে অনাকাঙ্খিত এ সঙ্কট দূর হবে ইনশাআল্লাহ। 

এ সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে ঋণগ্রহীতাই যেহেতু প্রধানত দায়ী, তাই তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কেই আগে আলোচনা করা যাক। 

১. ঋণগ্রহীতার এ কথা সর্বদাই মাথায় রাখা উচিত যে, ঋণগ্রস্ততা অনেক সময় দুশ্চিন্তা ও অশান্তি কারণ হয়। এ জন্য মানুষের কর্তব্য হলো, আল্লাহর কাছে ঋণগ্রহণ থেকে পানাহ চাওয়া এবং দুআ করা। তিনি যেন ঋণগ্রহণ ছাড়াই তার সকল প্রয়োজন পূরণ করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজে আল্লাহর কাছে ঋণগ্রহণ থেকে পানাহ চেয়ে দুআ করতেন। [বুখারী, হাদীস: ৮৩২]।

২. ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে বাস্তবিকই এর প্রয়োজন আছে কি-না। প্রয়োজন থাকলে সেটা কোন পর্যায়ের। ঋণগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনোভাবে তা পূরণ করা সম্ভব কি-না এবং ঋণগ্রহণ করলে সময়মতো তা পরিশোধ করা যাবে কি-না, এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা খুবই জরুরী। বিশেষ প্রয়োজন ও সময়মত পরিশোধের প্রবল ধারনা ছাড়া ঋণগ্রহণ জায়িয নয়। 

৩. সময়মত পরিশোধের পাক্কা নিয়ত রাখা এবং এর জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা। আর পরিশোধের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকা। কিন্তু ঋণ নেওয়ার সময়ই পরিশোধ না করার নিয়ত রাখা বা ঋণ নেয়ার পর সম্পূর্ণ উদাসিন হয়ে পড়া খুবই অন্যায় ও গুনাহের কাজ। সাহাবী আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ পরিশোধের নিয়তে ঋণ নেয়, আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করে দেন। আর যে আত্মসাতের উদ্দ্যেশ্যে নেয়, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন। [বুখারী, হাদীস: ২৩৮৭] ।

৪. নির্ধারিত সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করা। না পারলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই পরিশোধ করবে। টালবাহানা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, ছলচাতুরি করার কোন অবকাশ নেই। সাহাবী আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, [ঋণ আদায়ে] বিত্তবানের টালবাহানা জুলুম। [বুখারী, হাদীস: ২৪০০] 

৫. সময়মত ঋণ পরিশোধ না করলে ঋণদাতা থেকে কখনো কষ্টদায়ক আচরণ প্রকাশ পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা ও পাল্টা জবাব না দেয়া উচিত। কোন উযর থাকলে নম্রভাবে বুঝিয়ে বলা উচিত। একবার নবী কারীম (সঃ) এক ব্যক্তি থেকে একটি উটনি ঋণ নিয়েছিলেন। সে তা চাইতে এসে কঠোর ব্যবহার করল। তখন উপস্থিত সাহাবাগণ তার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করতে চাইলেন। নবী কারীম (সঃ) তাদেরকে বাঁধা দিয়ে বললেন, ‘তাকে বলতে দাও। পাওনাদারের কিছু বলার অধিকার আছে।’ [বুখারী, হাদীস: ২৩৯০]।

৬. ঋণদাতার জন্য দুআ করা এবং তার শোকরিয়া আদায় করা। এতে সে খুশি হবে এবং ঋণদানে উৎসাহ বোধ করবে। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আবী রাবীআহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুনাইন যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার কাছ থেকে ৩০ বা ৪০ হাজার দিরহাম ঋণ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনি তা পরিশোধ করলেন এবং আমার জন্য এই বলে দুআ করলেন, আল্লাহ তোমার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। ঋণের বিনিময়ে হল পরিশোধ ও কৃতজ্ঞতা। [আহমাদ, হাদীস: ১৬৪১০; সুনানে নাসাঈ, হাদীস: ৪৬৮৩]।

৭. ঋণ বান্দার হক, যা পরিশোধ করা জরুরী। অন্যথায় দাতার কাছ থেকে মাফ নিতে হবে। এ ছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া উত্তম। মৃত্যুর আগে তো অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। পরিশোধের আগেই যদি কারো মৃত্যু এসে যায়, তবে কাউকে অসিয়ত করে যাওয়া আবশ্যক। আশা করা যায়, এতে সে মাফ পাবে। 

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেন, ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গুনাহই মাফ করে দেয়া হয়। [মুসলিম, হাদীস: ১৮৮৬]। সাহাবী সালামা ইবনুল আকওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে- মহানবী (সঃ) একজন মাইয়ীতের জানাযা পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? লোকেরা বলল, জ্বী না। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো কি ঋণ আছে? লোকেরা বলল, তিন দিনার ঋণ আছে। তখন তিনি বললেন, তোমাদের সাথীর জানাযা তোমরাই পড়। এ কথা শুনে সাহাবী আবু কাতাদা রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তার জানাযার নামায পড়িয়ে দিন, তার ঋণ আমি আদায় করে দিব। তখন তিনি জানাযার নামায পড়ালেন। [বুখারী, হাদীস: ২২৮৯]।

ঋণ পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা না করে যাওয়ার কারণে জানাযা উপস্থিত হওয়ার পরও তার জানাযা পড়াতে অসম্মতি জানিয়েছেন। মূলত এ অসম্মতির মধ্য দিয়ে তিনি উম্মতকে এ বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, করয বা ঋণের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কেউই যেন একান্ত ঠেকা ছাড়া ঋণ না নেয়। নিতান্ত ঠেকায় পড়ে নিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা পরিশোধ করে। 

ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতারও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো- 

১. একান্ত দায়ে পড়ে কেউ করয চাইলে সামর্থ্য থাকলে ও মুনাসিব মনে হলে করয দিবে। কারণ ঋণ দেয়া মূলত হাজতমান্দ ও মুখাপেক্ষীকে সাহায্য করা। এ জন্য কুরআন-হাদীসে মুখাপেক্ষী ও বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করার যে সওয়াব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তা এখানেও প্রযোজ্য হবে। 

২. সময়মতো ঋণ পরিশোধে ঋণগ্রহীতা অক্ষম হলে সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া বা মাফ করে দেয়া অনেক বড় সওয়াবের কাজ। সাহাবী আবূ হুরায়রা (রা.) এর বর্ণনায় মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি অক্ষমকে সুযোগ দেয় বা আংশিক ঋণ কমিয়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়াতলে জায়গা দিবেন, যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। [তিরমিযী, হাদীস: ১৩০৬]।

৩. ঋণ তলবের সময় নম্রতা ও ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া কর্তব্য। কঠোরতা, গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত। সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসূলে আকরাম (সঃ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর রহমত নাযিল করুন, যে সুহৃদয় যখন বিক্রি করে, যখন ক্রয় করে এবং যখন নিজের হক তলব করে। [বুখারী, হাদীস: ২০৭৬]। 

৪. ভোগ্য ঋণ হোক বা ব্যবসায়ী ঋণ, মূলধনের অতিরিক্ত কোনো কিছুর শর্ত করা যাবে না। কারণ এটা সুদ। এরুপ কেউ করে ফেললে যথা নিয়মে তওবা করে কেবল মূলধনই গ্রহণ করবে। বাড়তিটা গ্রহণ করবে না। 

৫. খোটা দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে ঋণগ্রহীতাকে কষ্ট না দেয়া যাবে না। এতে ঋণদানের যে সওয়াব তা নষ্ট হয়ে যায়। এ জাতীয় অভ্যাস কারো থাকলে তা পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ তোমরা খোটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদকাকে সে ব্যক্তির মত নষ্ট করো না। যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। [বাকারা: ২৬৪] 

আমাদের এ দেশে এখন পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে করযে হাসানা চালু থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু নেই। এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করা গেলে দেশ ও জাতির কল্পনাতীত উপকার হবে। মানব ও মানবতা মুক্তি পাবে সুদ ও ক্ষুদ্রঋণের কালো থাবা থেকে। বিত্তবান দীনদার শ্রেণী উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো মেনে করযে হাসানার অশেষ ফযীলতের দিকে তাকিয়ে একক বা যৌথ উদ্যোগে করযে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার জন্য এর প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে পারেন। এটা করতে হবে কেবল বর্ণিত ফযীলত ও সওয়াবের আশায়। দুনিয়াবী কোনো উপকার বা লাভ-লোকসানের কথা মাথার বাইরে রাখতে হবে।

আপন দেশ/এইউ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়